মাড়ি থেকে রক্তপাত, যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে gingival bleeding বলা হয়, এটি একটি সাধারণ দাঁতের সমস্যা, যা প্রায়শই সঠিক মুখগহ্বর পরিচর্যার অভাবে ঘটে। সাধারণত তুচ্ছ মনে হলেও এটি gingivitis (মাড়ির প্রদাহ), periodontal disease (মাড়ির হাড়ের সমস্যা), বা অন্যান্য শারীরিক সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে। মাড়ি থেকে রক্তপাতের কারণ, প্রতিরোধ, এবং চিকিৎসা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকা ও সমস্যার কার্যকর ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত জরুরি।
মাড়ি থেকে রক্তপাতের কারণ
Gingivitis/ মাড়ির প্রদাহর অন্যতম লক্ষণ হল মাড়ি থেকে রক্তপাত। এই অবস্থায় মাড়ি লাল (reddness) এবং ফোলা (swelling) হয় যা ব্রাশ বা ফ্লস করার সময় রক্তপাত ঘটায়।
মাড়ি রক্তপাতকে দীর্ঘদিন উপেক্ষা করলে তা periodontal disease-এ রূপান্তরিত হতে পারে। এটি মাড়ির নরম টিস্যু এবং দাঁতের গোড়ার হার ধ্বংস করে, যার ফলে ক্রমাগত মাড়ি থেকে রক্তপাত এবং দাঁত আলগা হয়ে পড়ে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।
নিচে মাড়ির প্রদাহ (gingivitis) / মাড়ি থেকে রক্তপাত এর অন্যতম কিছু কারণ উল্লখ করা হল :
১ . Bad oral hygiene (ভুল মুখগহ্বর পরিচর্যা):
খাবারের পর যদি ভালোভাবে ব্রাশ ও ফ্লস করা না হয়, তবে দাঁতের উপর প্লাক (plaque) জমে। এই plaque মাড়ির প্রদাহ বা gingivitis এর অন্যতম কারণ ।
অপরিষ্কার দাঁতের উপর জমে থাকা প্লাক (plaque) দীর্ঘদিন ধরে পরিষ্কার না হলে তা টারটার /ক্যালকুলাসে পরিণত হয়। টারটার মাড়ির রক্তসঞ্চালন বাধাগ্রস্ত করে ও ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি সহজতর করে, যা gingivitis -কে আরও তীব্র করে তোলে।
এছাড়াও শক্ত ব্রিসলের টুথব্রাশ ব্যবহার বা জোরে দাঁত ব্রাশ করলে মাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যার ফলে রক্তপাত হয়।
২ . Vitamin deficiency (পুষ্টির অভাব):
ভিটামিনের অভাব মাড়ির বিভিন্ন রোগের কারণ হতে পারে। বিশেষ করে, ভিটামিন C এবং ভিটামিন D-এর অভাব মাড়ির সুস্থতার ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলে।
- ভিটামিন C-এর অভাব:
ভিটামিন C কোলাজেন উৎপাদনে সহায়তা করে, যা মাড়ির টিস্যুকে শক্তিশালী রাখে। এর অভাবে মাড়ি দুর্বল হয়ে যায়, ফোলা বা রক্তক্ষরণ হতে পারে এবং স্কার্ভি রোগ দেখা দিতে পারে, যা মারাত্মক মাড়ির সংক্রমণ ঘটাতে পারে। - ভিটামিন D-এর অভাব:
ভিটামিন D দাঁত ও হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। এটি ক্যালসিয়ামের শোষণে সাহায্য করে, যা মাড়িকে মজবুত রাখে। এর অভাবে মাড়ির প্রদাহ, সংক্রমণ এবং দাঁতের ক্ষয়জনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে। - ভিটামিন A মুখের লালা উৎপাদনে সহায়তা করে, যা মুখের ব্যাকটেরিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। এর অভাবে মুখ শুকিয়ে যায় এবং মাড়ির সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে।
- ভিটামিন K রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। এর অভাবে মাড়ি থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে।
- ভিটামিন B-কমপ্লেক্স বিশেষত, ভিটামিন B2 (রিবোফ্লাভিন) ও B3 (নায়াসিন) মাড়ির স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর অভাবে মাড়িতে প্রদাহ, ক্ষত বা সংক্রমণ হতে পারে।
ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন ফল, সবজি, দুধ, ডিম, মাছ এবং বাদাম খাওয়া উচিত। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী vitamin supplements নেওয়া যেতে পারে। নিয়মিত দাঁতের যত্ন ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস মাড়ির রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
৩ . Hormonal imbalance (হরমোনজনিত পরিবর্তন):
গর্ভাবস্থা, ঋতুস্রাব, মেনোপজ বা জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ির (contraceptive pills) কারণে হরমোনের তারতম্য ঘটে, যা মাড়িকে সংক্রমণের জন্য আরও সংবেদনশীল করে তোলে।
৪ . Side effects of certain medicine (ওষুধের প্রভাব):
কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কীভাবে মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ ঘটায়?
নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ গ্রহণের ফলে মাড়ির স্বাস্থ্য প্রভাবিত হতে পারে এবং মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। এসব ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মাড়ির সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে তোলে, রক্তপ্রবাহের মাত্রা পরিবর্তন করে এবং ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়।
a. ব্লাড থিনার (Blood Thinners) বা রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধকারী ওষুধ
যেসব ওষুধ রক্তকে তরল রাখতে সাহায্য করে, যেমন ওয়ারফারিন (Warfarin), অ্যাসপিরিন (Aspirin), হেপারিন (Heparin), ক্লোপিডোগ্রেল (Clopidogrel)—এগুলো মাড়ির রক্তনালীগুলোর কার্যকারিতা পরিবর্তন করে। ফলে মাড়িতে সামান্য আঘাত লাগলেও বা ব্রাশ করার সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে।
b. অ্যান্টিহাইপারটেনসিভ (উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ)
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত কিছু ওষুধ, যেমন ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার (Nifedipine, Amlodipine, Verapamil, Diltiazem) মাড়ির টিস্যুতে অতিরিক্ত বৃদ্ধি ঘটায়, যা জিঞ্জিভাল হাইপারপ্লাসিয়া নামে পরিচিত। এতে মাড়ি ফুলে যায় এবং রক্তক্ষরণের প্রবণতা বেড়ে যায়।
c. অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট এবং অ্যান্টিপসাইকোটিক ওষুধ
কিছু মানসিক রোগের ওষুধ, যেমন ফ্লুক্সেটিন (Fluoxetine), সেরট্রালিন (Sertraline), ক্লোনাজেপাম (Clonazepam), রিসপেরিডোন (Risperidone)—এগুলো মুখের লালা উৎপাদন কমিয়ে দেয়, ফলে মুখ শুকিয়ে যায় (Xerostomia) এবং ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি ঘটে। এর ফলে মাড়ি দুর্বল হয়ে যায় এবং সংক্রমণ হলে রক্তক্ষরণ দেখা দেয়।
d. অ্যান্টি-কনভালসেন্ট (মৃগী রোগের ওষুধ)
মৃগী বা খিঁচুনির চিকিৎসায় ব্যবহৃত কিছু ওষুধ, যেমন ফেনিটোইন (Phenytoin), ভ্যালপ্রোয়েট (Valproate) মাড়ির অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণ হতে পারে, যা রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়ায়।
e. ইমিউনোসপ্রেসেন্ট ওষুধ
যেসব রোগীদের অঙ্গ প্রতিস্থাপন (Organ Transplant) করা হয়েছে, তারা সাধারণত সাইক্লোসপোরিন (Cyclosporine) গ্রহণ করেন। এই ওষুধটি মাড়ির টিস্যুকে অতিরিক্ত বৃদ্ধি করতে পারে, যা মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণের কারণ হতে পারে।
f. কেমোথেরাপি ওষুধ
ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত কেমোথেরাপি ওষুধ মাড়ির কোষকে দুর্বল করে এবং সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়। এর ফলে মাড়ি ফুলে যেতে পারে এবং রক্তক্ষরণ হতে পারে।
৫ . Lifestyle changes (জীবনযাত্রার প্রভাব):
ধূমপান বা তামাক ব্যবহার মাড়ির স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে এবং ক্ষত নিরাময়ের গতি কমিয়ে দেয়। ধূমপান মাড়ির রক্তপ্রবাহ কমিয়ে দেয়, ফলে সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায়। তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের ফলে মাড়ির প্রদাহ দ্রুত বাড়তে পারে।
মাড়ি থেকে রক্তপাত প্রতিরোধের উপায়
১. Good oral hygiene (সঠিক মুখগহ্বর পরিচর্যা):
– প্রতিদিন সকালে এবং রাতে soft-bristled toothbrush দিয়ে দাঁত ব্রাশ করুন। মাড়িতে আলতো করে ব্রাশ করুন যেন মাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
– প্রতিদিন ফ্লস (dental floss) ব্যবহার করে দাঁতের ফাঁকে জমে থাকা খাদ্যকণা ও প্লাক (plaque) সরান।
২. Regular Dental check up (নিয়মিত ডেন্টিস্ট দেখান):
– প্রতি ছয় মাসে একবার ডেন্টাল চেকআপ এবং প্রয়োজন মত পরিষ্কার করান (scaling & polishing), যাতে plaque buildup প্রতিরোধ করা যায় এবং মাড়ির সমস্যাগুলো দ্রুত চিহ্নিত করা যায়।
৩. Balanced diet (সুষম খাদ্যাভ্যাস):
Vitamin C (লেবু, কমলালেবু) এবং Vitamin K (পালংশাক, বাঁধাকপি) সমৃদ্ধ খাবার খেয়ে মাড়িকে শক্তিশালী রাখুন।
৪. ধূমপান এবং তামাক ব্যবহার এড়িয়ে চলুন:
ধূমপান মাড়ির সুস্থতা নষ্ট করে এবং দ্রুত ক্ষতির কারণ হয়। এটি ছেড়ে দিলে মাড়ির স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে।
৫. Antibacterial Mouthwash ব্যবহার করুন:
অ্যান্টিসেপটিক মাউথওয়াশ দিয়ে কুলকুচি করলে ব্যাকটেরিয়া কমে এবং প্রদাহ নিয়ন্ত্রণে আসে।
৬. মানসিক চাপ (stress) নিয়ন্ত্রণ করুন:
অতিরিক্ত মানসিক চাপ ইমিউনিটি ( দুর্বল করে এবং মাড়িকে সংবেদনশীল করে তোলে। স্ট্রেস কমাতে মেডিটেশন বা যোগব্যায়াম করতে পারেন।
মাড়ি থেকে রক্তপাতের চিকিৎসা
১. ডেন্টাল ক্লিনিং (scaling and polishing):
ডেন্টিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী scaling এবং root planing এর মাধ্যমে জমে থাকা প্লাক ও টার্টার সরিয়ে ফেলা সম্ভব, যা মাড়ি থেকে রক্তপাতের প্রধান কারণ।
২. ওষুধ:
মাড়ির প্রদাহ / gingivitis কমাতে আপনার চিকিৎসক মাউথওয়াশ , অ্যান্টিবায়োটিক জেল , অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট , পেইন রিলিফ ওষুধ (Ibuprofen, Paracetamol) prescribe করতে পারেন। সঠিক চিকিৎসার জন্য দন্ত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরী ।
৩. সার্জিক্যাল চিকিৎসা:
যদি মাড়ির সমস্যা গুরুতর হয়, তবে flap surgery, bone grafting, বা tissue grafting-এর মতো চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে।
৪. অন্য রোগের চিকিৎসা:
যদি মাড়ি থেকে রক্তপাতের কারণ অন্য কোনো শারীরিক সমস্যা বা ওষুধ হয়ে থাকে, তবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সেগুলোর চিকিৎসা করাতে হবে।
ঘরোয়া প্রতিকার
১. নুন-জলে কুলকুচি:
এক গ্লাস উষ্ণ জলে এক চা চামচ লবণ মিশিয়ে কুলকুচি করলে মাড়ির প্রদাহ কমে।
২. ঠান্ডা সেঁক:
গালের বাইরের অংশে ঠান্ডা সেঁক দিলে মাড়ির ফুলে যাওয়া ও ব্যথা সাময়িকভাবে কমে।
কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন?
যদি মাড়ি থেকে রক্তপাতের পাশাপাশি ক্রমাগত ব্যথা, মাড়ির অতিরিক্ত ফোলাভাব, দাঁতের নড়াচড়া, দুর্গন্ধযুক্ত শ্বাস, বা শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন দেখা যায়, তবে অবিলম্বে ডেন্টিস্ট বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
সঠিক মুখগহ্বর পরিচর্যা, পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস, এবং নিয়মিত ডেন্টাল চেকআপের মাধ্যমে মাড়ি থেকে রক্তপাত প্রতিরোধ করা সম্ভব। তবে, দীর্ঘস্থায়ী বা গুরুতর সমস্যার ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া জরুরি।
Sources:
- https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/gingivitis/symptoms-causes/syc-20354453#:~:text=Gingivitis%20can%20cause%20bright%20or,Bad%20breath.
- https://www.healthline.com/health/gingivitis